ব্ল্যাক
আউট:
আমাদের দেশে ২০১৪ সালের ১ নভেম্বর বেলা ১১টা ২৭ মিনিটে সারাদেশ বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। টানা ১২ ঘণ্টা পুরো দেশে বিদ্যুৎ
ছিল না। দেশজুড়ে এই ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় ব্ল্যাক আউট নামে পরিচিত।
২০০৭-এর পর এতো বড় বিদ্যুত্ বিপর্যয় হয়নি
বাংলাদেশে। সে বছর একটি শক্তিশালী সাইক্লোনের জেরে ন্যাশনাল গ্রিড খারাপ হয়ে যায়।
অন্ধকার হয়ে যায় গোটা দেশ।
২০১৪ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিপর্যয় হল ২০১৪ সালের একটি শিল্প বিপর্যয়, যেটিতে সারা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, যা বাংলাদেশ সময় নভেম্বর ১-এর সকাল ১১.৩০ থেকে নভেম্বর ২-এর মাঝ রাত পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই বিপর্যয়টি বিশ্বের অনেক বড় ও ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয়সমূহের মধ্যেতে ১টি বড় যাতে ১৫কোটি নাগরিকরা আক্রান্ত হন।
প্রথমতঃ
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৯টি,
নরসিংদীর
ঘোড়াশাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৬টি ইউনিটই বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ভেড়ামায়
বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রের ত্রুটির কারণে সবকটি ইউনিটে একযোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে
যায়। এতে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিপর্যয় দেখা দেয়। কুষ্টিয়া থেকে
ওয়েস্ট জোন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুর রহমান জানান,
বেলা ১১টা ২৯
মিনিটে ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ এলাকায় জাতীয় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনে ত্রুটি
দেখা দেওয়ার পর "ব্ল্যাক আউট" বা "বিদ্যুৎ বিপর্যয়" হয়।
ভারতীয় এবং বাংলাদেশী সরবরাহ লাইনের সংযোগস্থলে ক্রুটি দেখা দিয়েছে বলেও জানান
তিনি।
একটি দেশের গ্রীড সিস্টেমকে জাতীয় গ্রীড বলা হয়। আর জাতীয় গ্রীড সাধারনত ইনফাইনেট (Infinate) বাস হয়। যে বাসের ভোল্টেজ বা ফ্রিকুয়েন্সি লোড বৃদ্ধির কারনে বৃদ্ধি পায়না, সেটাকেই ইনফাইনেট বাস বলে। আমাদের দেশের বানিজ্যিক ফ্রিকুয়েন্সি ৫০ হার্টজ। কোন কারনে যেন এটা না কমে, সেজন্যই প্রতিটি দেশেই ইনফাইনেট বাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। একটা দেশের গ্রীড সিস্টেম বিভিন্ন পাওয়ার প্লান্টের সাথে সংযুক্ত। এছাড়া অন্য দেশের গ্রীড সিস্টেম বা লাইনের সাথেও যুক্ত থাকে। এখন যদি আপনি পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া হঠাৎ করে অন্য দেশের গ্রীড বন্ধ করে দেন, তাহলে ফুল লোডের চাপ জাতীয় গ্রীডের উপর পরে। হঠাৎ করে লোড অনেক বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে ফ্রিকুয়েন্সি কমে যায়। আমদের জেনারেটর এমন ভাবে সংযোগ করা থাকে, যেন নির্দিষ্ট ফ্রিকুয়েন্সির নিচে নামলেই জেনারেটর অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। এমনটাই হয়েছিল সেদিন। হঠাৎ লোড বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে ফ্রিকুয়েন্সি কমে যায়। তাই পাওয়ার প্লান্টের জেনারেটর গুলো অটোমেটিক বন্ধ হতে থাকে। যেহেতু সব জেনারেটর গ্রীডের মাধ্যমে ইন্টারকানেক্ট, তাই আস্তে আস্তে সমগ্র বাংলাদেশেরই পাওয়ার কাট হয়ে যায়।
তাই কখনোই হঠাৎ করে লোড না কমিয়ে পাওয়ার কাট করা হয়না। সাধারন তথ্য মতে ভারতীয় গ্রীড অংশে হঠাৎ করে লাইন অফ করে দেওয়ার কারনে এমনটি ঘটেছিল।
কোথাও গ্রীড থেকে দ্রুত বিদ্যুত্ কমিয়ে ফেললে অন্যান্য নিয়ন্ত্রণ
সেন্টারগুলোতে কারেন্ট সরবরাহে দ্রুত লোড ম্যানেজ (সরবরাহে Re-configure করা) করতে হয়। না হলে যে অসাম্য প্রবাহ সৃষ্টি হয় তাতে প্রতিটি
প্লান্টে মটর উল্টাদিকে ঘুরতে শুরু করে এবং প্লান্টের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সেটা রোধ
করতে প্রতিটি প্লান্টে সেফটি সার্কিট ব্রেকার থাকে যা প্লান্টকে রক্ষা করতে গিয়ে
ট্রিপ করে বা আপনা থেকে প্লান্টকে বন্ধ করে দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে প্লান্ট বন্ধ না
হলে ফোর্স শাট ডাউন দিতে হয়। ন্যাশনাল গ্রীড থেকে প্লান্টকে বিচ্ছিন্ন করে প্লান্ট
চালু রাখার পদ্ধতি আছে। সেটা করতে গেলে প্লান্ট থেকে বিদ্যুত্ হঠাত্ আঞ্চলিক
গ্রীডে সরবরাহ দেয়া যায়। তাতে বড় আকারের প্লান্ট হলে তার বিদ্যুত্ সরবরাহ
ব্যবস্থায় দ্রুত কনফিগার করতে হয়, না হলে অসাম্য সৃষ্টি
হয়ে যাবে। সেরূপ পরিস্থিতিতে প্লান্ট ট্রিপ করানো বা বন্ধ করা উত্তম পন্থা মনে
করে। ছোট খাট প্লান্ট বন্ধ হলে বা হঠাত্ চালু করলে এরকম কোন সমস্যা হয় না। এখনকার
দিনে এরূপ পরিস্থিতি দ্রুত ম্যানেজ করার সেফটি ব্যবস্থা ও দ্রুত রি-কনফিগার করার
ব্যবস্থা অনেক দেশে করা হয়েছে। ন্যাশনাল গ্রীডের ক্যাপাসিটি আমাদের দেশে ২৩০ ও ১৩২
কেভিএ লাইন। সেটা অনেক দেশেই ৪০০ কেভিএ। বাংলাদেশে ৪০০ কেভিএ করা হচ্ছে।
কারণঃ
এসব ব্লাক আউট কীজন্য হয়। দি এডিশন ইলেক্ট্রিক ইনষ্টিটিউট বলে একটি আমেরিকান সংস্থা তাদের গবেষণায় বলেছে, ব্লাক আউট এর ৭০% ঘটে প্রকৃতিগত কারণে। ১১% ঘটে বড় কোন পাখি, কোন পিলারের বা গাছ পড়ে বা হিউম্যান এর কারণে। বাকিটা টেকনিক্যাল কারণে।
কোন কোন দেশে একাধিক গ্রীড থাকলেও প্রধানত একটি গ্রীডই সব
দেশে থাকে। এর
সাথে সকল উত্পাদন প্লান্টগুলো প্যারালালি কানেকটেড থাকে।
বিভিন্ন প্লান্টে বিদ্যুত্ উত্পাদন যা হয় তা জাতীয় গ্রীডে
সরবরাহ হয়। সেটা এক মহানদীর মত। সেখান থেকে বিভিন্ন সাব-ষ্টেশন এর বিশাল ট্রান্সফরমার
দ্বারা প্রয়োজনমত বিদ্যুত্ প্রবাহ নেয়া হয়। প্রধান লাইনগুলো থাকে ২৩০ কেভি লাইনের, থাকে ১৩২ কেভি লাইনের। এখন জাতীয় গ্রীড
লাইন ৪০০ কেভির করা হচ্ছে। যদিও এখন যা বিদ্যুত্ উত্পাদন হচ্ছে তার কয়েকগুণ
বিদ্যুত্ সরবরাহেও জাতীয় গ্রীডের বিদ্যমান লাইন পর্যাপ্ত। জাতীয় গ্রীড থেকে ১৩২
কেভি বা ৩৩ কেভি বা ১১ কেভি লাইন দ্বারা আঞ্চলিক প্রবাহ নেটওয়ার্ক তৈরি করা হয়।
গ্রাহক পর্যায়ে ৪২০ ভোল্ট বা ২২০ ভোল্ট লাইন থেকেও বিদ্যুত্ দেয়া হয়। বড় গ্রাহক
বলে ১১ কেভি লাইন থেকে দেয়া হয়। এই পুরো ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থাটি পরস্পরের সাথে
যুক্ত। এখানে কোথাও ব্যবহার কমে গেলে সেখান বিদ্যুত্ সরিয়ে যেখানে ব্যবহার বেশি
সেখানে নেয়া হয়। কখনো ব্যবহার কমলে কোন কোন প্লান্ট বন্ধ রাখা হয়। পিক আওয়ারে
ব্যবহার দ্রুত বাড়তে থাকলে পিকিং প্লান্টগুলো চালু করা হয়।
ব্যবহার ও সরবরাহে
বিশাল কোন তারতম্য ঘটলে সেখানে ফ্রিক্যুয়েন্সিতে বড় হেরফের হলে প্লান্টের ক্ষতি
হবে। তখন কোন কোন লাইন ও প্লান্টকে পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে সেফটি সার্কিট
ব্রেকার অফ হয়ে যাবে।